আরিফ খানঃ পাবনা বেড়া উপজেলার কাজিরহাট-আরিচা নৌপথে স্পিডবোটে পারাপারে দীর্ঘ কয়েক বছর পর ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। কিন্তু এর তোয়াক্কা করছেন না বোট মালিকরা। ২১০ টাকার ভাড়া নেয়া হচ্ছে ২৫০ টাকা। এর সাথে যুক্ত করা হচ্ছে আরও ৫ টাকা ঘাটে প্রবেশ ফি হিসেবে। এছাড়া অতিরিক্ত যাত্রী বহন ও পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট সরবরাহ না করারও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও কোন বৈরি আবহাওয়া মানে না তারা এসব নিয়ম মানতে বিভিন্নভাবে তাগিদ দিলেও কাউকেই মানছেন না বোট মালিকরা। এতে সেই ভোগান্তিই পোহাচ্ছেন যাত্রীরা। প্রশাসনের উপস্থিতিতে মূহূতেই নিয়ম পরিবর্তন সড়ে আসলেই ফের আগের জায়গায়।
তথ্য বলছে, ২০১৮ সালে সর্বশেষ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে ১৫০ টাকা করে স্পিডবোটের ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এরপর আর সরকারিভাবে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়নি। বোট পরিচালনা ব্যয় ও যাত্রী স্বার্থ বিবেচনায় বিআইডব্লিউটিএ ও বোট মালিকরা মৌখিকভাবে নির্ধারণ করে এতোদিন ভাড়া আদায় করেছেন। এরপর চলতি বছরের ৯ এপ্রিল আরিচা-কাজিরহাট নৌপথে স্পিডবোটের যাত্রী ভাড়া ২১০ টাকা নির্ধারণ করে বিআইডব্লিউটিএ। কিন্তু এ ভাড়া নীতিমালা মানছেন না বোট মালিকরা।.
সরেজমিনে কাজিরহাট ঘাট এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কাউন্টার থেকে ২৫০ টাকায় স্পিডবোটের টিকিট নিচ্ছেন যাত্রীরা। টিকিটেও এর মূল্যমান ২৫০ টাকা-ই লেখা রয়েছে। তবে টিকিটে বিআইডব্লিউটিএ, সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের সিল নেই। কোনো কোনো যাত্রীরা সরকার নির্ধারিত ভাড়ার কথা বললেও এই ভাড়ায়ই যেতে হবে বলে জানানো হচ্ছে কাউন্টার থেকে। ফলে বাধ্য হয়েই অতিরিক্ত টাকায়ই টিকিট নিচ্ছেন যাত্রীরা।
যাত্রীরা বলছেন, সাধারণ ভাড়ার তুলনায় নেয়া হচ্ছে ৪৫ টাকা বেশি। ১২ জন করে নেবার নিয়ম থাকলেও এক বোটে গাদাগাদি করে ১৮-২২ জন করেও যাত্রী নেয়া হচ্ছে। কখনো লাইফ জ্যাকেট দিচ্ছেন, কখনো দিচ্ছেন না। এতে ঝুঁকি ও ভোগান্তির শেষ নেই তাদের।
সাঁথিয়া থেকে ঢাকা যাত্রি মুরসালিন ইসলাম অতিরিক্ত ভাড়ার ব্যাপারে বলেন, এরা সরকারকেও মানে না। সেখানে আমাদের মানবে? কাউন্টারে গেলে অতিরিক্ত কোনো কথা বলার সুযোগ নেই। এই ভাড়াতেই যেতে হবে, নাহলে অন্যভাবে যান বলে অপমানজনক আচরণ করা হয়। এগুলো দেখবে কে?
আরও একজন ঢাকা যাত্রি সাইফুল ইসলাম, ২১০ টাকা ভাড়া বেধে দিলো সরকার। অথচ নেয়া হচ্ছে ২৫৫ টাকা। কাউন্টারে ২৫০ টাকা ও ঘাটে ঢুকতেই আরেকটি টিকিট হাতে ধরিয়ে দিয়ে নেয়া হচ্ছে আরো ৫ টাকা। অথচ যতটুকু জানি তাতে ওই ২১০ টাকার মধ্যেই ঘাটে প্রবেশ ফি রয়েছে। এভাবেই সাধারণ মানুষের পকেট কাটা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এগুলো বন্ধ করা উচিত।
ঢাকা থেকে পাবনা ফিরছিলেন নাবিল হোসেন তিনি জানান, ওপার এপার দুইপার একই সুতয় গাঁথা। নির্ধারিত ভাড়া যদি বাস্তবায়ন না-ই করা যাবে তাহলে নির্ধারণের দরকার কি। সরকার বলছে ২১০, ব্যবসায়ীরা তা না মেনে নিচ্ছেন ২৫৫। পরিবর্তন তো কিছু দেখছি না। কয়েকদিনের মধ্যেই ঈদযাত্রা শুরু হবে। অসংখ্য মানুষ পার হবেন। তাদেরও একইভাবে হয়রানি করা হবে। এর আগেই এ সমস্যার সমাধান করা উচিত।
তারা আরও জানান, যে বোটটি ছাড়বে, দেখুন এতে ২০-২২ জন যাত্রী তোলা হয়েছে। এভাবে ঠাসাঠাসি করে বসা যায় না জানালে চালকরা দুর্ব্যবহার করে। এগুলো কর্তৃপক্ষের চোখে পড়ে না?
তবে এসব অভিযোগের বিপরীতে নানা যুক্তি রয়েছে বোট চালক ও মালিকদের। তারা বলছেন, প্রতি ট্রিপে একটি বোটের পেছনে ব্যয় রয়েছে কমপক্ষে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় লোকসানে পড়বেন তারা।
এব্যাপারে স্পিডবোট চালক শফিক ও শামিম বলেন, এক ট্রিপে ২২ লিটার তেল লাগে। সে হিসেবে ২৭০০-২৯০০ টাকার তেল লাগে। সাথে চালক ও ঘাট খরচ আছে। তাতে এসব খরচ মিটিয়ে মালিকদের কিছুই থাকে না। সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় স্পিডবোট চালালে মালিকরা লোকসানে পড়বে। বোট চালাতে পারবে না।
লাইফ জ্যাকেট ও অতিরিক্ত যাত্রীর প্রশ্নে তারা বলেন, লাইফ জ্যাকেট দিলেও যাত্রীরা পরে না। গরমের জন্য খুলে ফেলে। বড় বোটে যাত্রী বেশি নেয়া যায়। এজন্য দুএকজন বেশি নেয়া হয় কখনো।
বোট মালিক সমিতির সভাপতি ও বেড়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রইস উদ্দিন বলেন, অনেক আগে থেকেই ২৫০ টাকা ভাড়া-ই নেয়া হয়। ওইভাবেই নেয়া হচ্ছিলো। এখন সপ্তাহ দুয়েক আগে প্রজ্ঞাপন হয়েছে নতুন ভাড়ার। কম হলেও ভাড়া সমন্বয় করতে হবে। ব্যস্ততায় আমি ঢাকায় থাকার কারণে এটি করা হয়নি। ফিরে দ্রুতই ভাড়া আদায়ের ব্যাপারটা সমন্বয় করা হবে।
বিআইডব্লিউটিএ সূত্র বলছে, গত ১৪ ডিসেম্বর প্রথম পর্যায়ে ৫৪ টি বোটের রুট পারমিট দেয়া হয়। পরে কয়েকটি ধাপে আরো বেশকিছু বোটকে রুট পারমিট দেবার পর আরিচা ও কাজিরহাট দুই পাড়ে এখন মোট ১৪২ টি স্পিডবোট চলাচল করছে।
বিআইডব্লিউটিএ এর নগরবাড়ি-কাজীরহাট ঘাট কার্যালয়ের পোর্ট অফিসার আব্দুল ওয়াকিল বলেন, সপ্তাহ দুয়েক আগে এই রুটে ২১০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন হয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে বোট মালিকদের সাথে নতুন ভাড়া আদায় ও অন্যান্য নিয়ম পালনের ব্যাপারে কথা বলেছি। কিন্তু তারা সেই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় এখনো অব্যাহত রেখেছেন। আমরা আবার তাদের সাথে কথা বলব। স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় অভিযান চালাবো। এরপরও যদি তারা নির্দেশ না মানেন তাহলে প্রয়োজনে তাদের রুট পারমিট বাতিল করা হবে। ঈদযাত্রা শুরুর আগেই আমরা এটির একটি সমাধান করব।
এব্যাপারে বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোরশেদুল ইসলাম বলেন, কয়েকদিন আগেও আমরা অভিযান চালিয়ে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেছি। কিন্তু এতেও এ অনিয়ম বন্ধ হচ্ছে না। অভিযানে গেলে দুইপাড় থেকেই বোট চালানো বন্ধ করে দেয়। আমাদের উপস্থিতিতে সব ঠিক হয়ে যায় পরে আবার শুরু করে এরপরও আমরা তৎপর রয়েছি। বিআইডব্লিউটিএ সহযোগিতা চাইলে অবশ্যই সেটি করা হবে।
প্রসঙ্গত, ঢাকার সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর ও সময় বাঁচানোর লক্ষ্যে ২০১৬ সালের দিকে কাজীরহাট-আরিচা নৌরুটে লঞ্চ ও ফেরির পাশাপাশি স্পিডবোট চলাচল শুরু হয়। সাধারণত ১৩ ও গ্রীষ্মকালে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দুরত্বের এই নৌপথে ৪ টি ফেরি ও ৯ টি লঞ্চ চলাচল করে। এর সাথে বর্তমানে ১২ সিটের ১৪২ টি স্পিডবোট চলে দুইপাড়ে (আরিচা ও কাজিরহাট)। এতে করে এক ঘন্টারও বেশি সময়ের জলপথ পাড়ি দেয়া যায় ১৫ থেকে ২০ মিনিটে। একারণে প্রতিদিন হাজারেরও অধিক মানুষ যাতায়াত করেন স্পিডবোটে। ঈদের সময়ে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৫ হাজার যাত্রী যাতায়াত করেন। সড়কপথে ঢাকার সাথে পাবনার দুরত্ব ৫ থেকে ৬ ঘন্টার। যানজটের কবলে পড়লে লাগতে পারে ৮ থেকে ১২ ঘন্টা সময়। সেখানে কাজিরহাট-আরিচা নৌপথে ঢাকা যেতে সময় লাগে ৪ থেকে সাড়ে ৪ ঘন্টা। দীর্ঘ সময় ক্লান্তির যাত্রায় ভোগান্তি কমাতে মানুষ এই নৌপথ দিয়ে চলাচল করেন।