নাছির হোসাইনঃ পাবনার বেড়া-সাঁথিয়ায় অবাধে তৈরি হচ্ছে নিষিদ্ধ চায়না দুয়ারী জাল। জলজ জীববৈচিত্রের জন্য চায়না দুয়ারী জাল কারেন্ট জালের চেয়েও ক্ষতিকর। এ জাল সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে মাছ আটকে রাখতে সক্ষম। জালের বুননে এক গিঁঠ থেকে আরেক গিঁঠের দূরত্ব খুব কম হওয়ায় মাছ বা অন্য কোনো ক্ষুদ্র জলজ প্রাণী একবার এ জালের মধ্যে প্রবেশ করলে আর বের হতে পারে না। অন্য জালের চেয়ে কম পরিশ্রমে চায়না দুয়ারী জালে অধিক পরিমাণ মাছ পাওয়া যায়।
বর্ষা মৌসুম শুরুতে খালবিলে নদী-নালায় ঢুকেছে নতুন পানি। বেড়েছে দেশী মাছের আনাগোনা। আর এই সুযোগে অসাধু মৎস্য শিকারিরা নেমেছে এসব মাছ নিধনে। প্রতিদিন স্থানীয় হাট-বাজারগুলোতে বিক্রি হচ্ছে এসকল মাছ। বিশেষ করে ছোট মাছ ও পোনা মাছ বিক্রি হচ্ছে বেশি। বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলায় হাত বাড়ালেই মিলছে নিষিদ্ধ অবৈধ চায়না দুয়ারী জাল। যত্রতত্র স্থাপন করা হয়েছে ছোট বড় অবৈধ চায়না জাল কারখানা। এসকল কারখানায় তৈরি করা হচ্ছে ডিম থেকে শুরু করে সকল প্রকার মাছ ধরার ফাঁদ চায়না দুয়ারী।
চায়না দুয়ারী জাল সাধারণত এক থেকে দেড় ফুট উচ্চতা এবং ৫০ থেকে ১০০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ক্ষুদ্র ফাঁসবিশিষ্ট ঢলুক আকৃতির হয়ে থাকে। লোহার চারটি রড ও রডের রিং দিয়ে খোঁপ খোঁপ আকারে বক্স তৈরি করে চারপাশ সূক্ষ্ম জাল দিয়ে ঘিরে তৈরি করা হয়। এই ফাঁদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, নদীর তলদেশে লম্বালম্বিভাবে লেগে থাকে। ফলে কোনো ধরনের খাদ্যদ্রব্য ছাড়াই দুদিক থেকেই মাছ ঢুকে আটকা পড়ে। তবে কেউ কেউ অতিরিক্ত মাছের আশায় ঘ্রাণ জাতীয় মাছের খাবার দিয়ে থাকে।
স্থানীয় জেলেরা জানান, বিকেল হলেই ছোট ছোট ডিঙিতে করে এই চায়না দুয়ারী নদীতে ফেলা হয়। সারা রাত নদীতে রাখার পর সকালে তুলে আনা হয় পাড়ে। এ সময় জালে ধরা পড়ে দেশীয় প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় সব মাছ, নদীতে থাকা জলজ প্রাণী এমনকি ছেঁকে ওঠে মাছের ডিমও।
চায়না দুয়ারীতে সব ধরনের মাছ ছেঁকে ওঠে, সহজেই মাছ ধরা যায় এবং দাম কম হওয়ায় বেশির ভাগ জেলে বর্তমানে এ দুয়ারী ব্যবহার করছেন। এ ছাড়া অনেক শৌখিন মৌসুমি মৎস্য শিকারিরা মাছ ধরতে নেমেছেন। ফলে যাঁরা পুরোনো কৌশলে মাছ ধরতেন, তাঁদের জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই অনেকেই বাধ্য হয়ে চায়না দুয়ারী কিনছেন।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায় বেড়া উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত যমুনা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ও সাঁথিয়া উপজেলার সব খাল-বিলে অবাধে এই জাল ব্যবহার করা হচ্ছে। আশেপাশের প্রতিটি গ্রাম অঞ্চলের খাল বিল গুলোতেও চলছে চায়না জাল ব্যবহারের মহোৎসব! ভোর হতে রাত অব্দি এ জাল ফেলার ধুম পরে যায় বেড়া উপজেলার নগরবাড়ি, ইসলামপুর ,কাজিরহাট, বসন্তপুর, পূর্বশ্রীকন্ঠদিয়া, সাঁথিয়ার মুক্তার বিল, সাতআনির বিল, গজারিয়ার বিল সহ সব খাল-বিলে যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই দেখা যায় চায়না দুয়ারি জালের।
অনুসন্ধানে যানা যায়, গ্রামঅঞ্চলের প্রতিটি ঘরে-ঘরে এখন চায়না জাল। সহজে মাছ ধরা যায় বলে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও।
এ বিষয়ে স্থানীয় সচেতন ব্যাক্তিরা জানান, এ জালের ধোঁকায় পড়ে নিরবংশ হতে চলেছে দেশ থেকে সকল প্রজাতির মাছ, কুঁচিয়া, সাপ, গুইসাপ, শামুক, জোক, পোনামাছ, কাঁকড়া, কচ্ছপ সহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী। নদী ও বিলের সকল প্রান্তে দেখা যায় এই জলজ প্রজাতি ধংসের মরণ ফাঁদ। এছাড়াও কয়েকদিন জাল পানিতে থাকলে জালের গায়ে জমা শ্যাওলা শুকাতে রোদে দিতে হয়। তখন আবার সেই জালের সাথে আটকে থাকা ছোট মাছ বা পোকামাকর খেতে এসে আটকা পড়ে পাখি। এভাবে অনেকেই এই জালকে পাখি শিকারের জাল হিসেবে ব্যাবহার করছে। মানে জলে এবং স্থলে সবখানেই বিপদজনক এই চায়না জাল। ভয়ঙ্কর এই চায়না জাল ক্রয় বিক্রয়ের দ্রুত বন্ধের দাবি জানান তার। চায়না জালের বিরুদ্ধে সাঁথিয়া উপজেলায় অভিযান পরিচালিত হলেও বেড়া উপজেলায় কোন অভিযানের খবর শোনা যায় নি এ বছর।
মৎস্যজীবী রামপদ হালদার বলেন এই চায়না দোয়ারি জালের ফাঁদের কারণে নদী-নালা জলাশয়গুলো দিন দিন মাছশূন্য হয়ে পড়ছে। আগে যমুনা নদীতে সারা বছর অনেক মাছ পাওয়া গেলেও এখন বর্ষায়ও মাছ নেই। বেড়ার নতুন ভারেঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের (সোনাপদ্মার) প্রতিষ্ঠাতা ও প্রবীণ শিক্ষক এ কে এম আবদুল কালাম বলেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পুষ্টির প্রধান উৎস সংরক্ষণ এবং জীববৈচিত্র্য যাতে বাস্তসংস্থানের মাধ্যমে জীব কুলকে রক্ষা করা যায় এবং পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখার মহান ব্রত নিয়ে চায়না দোয়ারি বিরুদ্ধে প্রশাসন সহ সকল কে এগিয়ে আসতে হবে। জলজ জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে ফেলা এই চায়না দোয়ারি নামক মরণ ফাঁদ নিয়ন্ত্রণে সুশীল সমাজের দায়িত্ব রয়েছে।
বেড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহা. নাসির উদ্দিন জানান, মৎস্য সম্পদ রক্ষায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও নৌ পুলিশের সাথে কথা বলে দ্রুতই অভিযান পরিচালনা করা হইবে। চায়না দোয়ারি ব্যবহারের প্রভাবে ভবিষ্যতে দেশি প্রজাতির মাছ চরম অস্তিত্ব-সংকটে পড়বে। দেশের মৎস্য সম্পদ রক্ষায় ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য চায়না দোয়ারি ব্যবহার বন্ধে সকল কে আহবান জানান তিনি। সাঁথিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোছাঃ রিজু তামান্না বলেন, দেশীয় প্রজাতির মাছ রক্ষায় ও মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মঙ্গলবার প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকার জব্দ করে পুড়িয়ে ফেলা ও বিশ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। গেল সপ্তাহে উপজেলার গৌরিগ্রামের সাতানির বিলে অভিযান চালিয়ে আনুমানিক ৫০হাজার টাকা মূল্যের অবৈধ চায়না দুয়ারি জাল জব্দ করে পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়েছে। জনস্বার্থে অভিযান অব্যাহত থাকবে।